রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর একটা মনোজ্ঞ কবিতা "বোঝাপড়া "
বোঝাপড়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মনেরে আজ কহো যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লহ সহজে ।
কেউ বা তোমায় ভালোবেসে
কেউ বা বাসতে পারে না যে ,
কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা
সিকি পয়সা ধারে না যে ।
কতকটা যে স্বভাব তাদের ,
কতকটা বা তোমারো ভাই,
কতকটা এ ভবের গতিক-----
সবার তরে নহে সবাই ।
তোমায় কতক ফাঁকি দেবে,
তুমিও কতক দেবে ফাঁকি,
তোমার ভোগে কতক পড়বে,
পরের ভোগে থাকবে বাকি ।
মান্ধাতারই আমল থেকে
চলে আসছে এমনি রকম
তোমারি কি এমন ভাগ্য
বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম ।
মনেরে আজ কহো যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লহ সহজে ।
অনেক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বুঝি
এলে সুখের বন্দরেতে ,
জলের তলে পাহাড় ছিল
লাগল বুকের অন্দরেতে ,
মুহূর্তেকে পাঁজরগুলো
উঠল কেঁপে আর্তরবে---
তাই নিয়ে কি সবার সঙ্গে
ঝগড়া করে মরতে হবে?
ভেসে থাকতে পার যদি
সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয়,
না পার তো বিনা বাক্যে
টুপ করিয়া ডুবে যেয়ো ।
এটা কিছু অপূর্ব নয়,
ঘটনা সামান্য খুবই---
শঙ্কা যেথায় করে না কেউ
সেইখানে হয় জাহাজ-ডুবি ।
মনেরে তাই কহো যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লহ সহজে ।
তোমার মাপে হয় নি সবাই,
তুমিও হও নি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায় ,
কেউ বা মরে তোমার চাপে---
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি?
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি ।
আকাশ তবু সুনীল থাকে ,
মধুর ঠেকে ভোরের আলো ,
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো ।
যাহার লাগি চক্ষু বুজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর ।
মনেরে তাই কহো যে ,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লহ সহজে ।
নিজের ছায়া মস্ত করে
অস্তাচলে বসে বসে
আঁধার করে তোল যদি
জীবনখানা নিজের দোষে
বিধির সঙ্গে বিবাদ করে
নিজের পায়েই কুড়ুল মার,
দোহাই তবে এ কার্যটা
যত শীঘ্র পার সারো ।
খুব খানিকটে কেঁদে কেটে
অশ্রু ঢেলে ঘড়া ঘড়া---
মনের সঙ্গে এক রকমে
করে নে ভাই বোঝাপড়া,
তাহার পরে আঁধার ঘরে
প্রদীপখানি জ্বালিয়ে তোলো ।
ভুলে যা ভাই কাহার সঙ্গে
কতটুকুন তফাত হল ।
মনেরে তাই কহো যে ,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লহ সহজে ।
(------------"ক্ষণিকা ")
No comments
THANKS.