শৈশবসন্ধ্যা -----------রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শৈশবসন্ধ্যা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ধীরে ধীরে বিস্তারিছে ঘেরি চারি ধার
শ্রান্তি আর শান্তি আর সন্ধা-অন্ধকার,
মায়ের অঞ্চল-সম । দাঁড়ায়ে একাকী
মেলিয়া পশ্চিম-পানে অনিমেষ আঁখি
স্তব্ধ চেয়ে আছি ।আপনারে মগ্ন করি
অতলের তলে, ধীরে লইতেছি ভরি
জীবনের মাঝে--- আজিকার এই ছবি,
জনশূন্য নদীতীর, অস্তমান রবি,
ম্লান মূর্ছাতুর আলো--- রোদন-অরুণ,
ক্লান্ত নয়নের যেন দৃষ্টি সকরুণ
স্থির বাক্যহীন--- এই গভীর বিষাদ,
জলে স্থলে চরাচরে শ্রান্তি অবসাদ ।
সহসা উঠিল গাহি কোন্ খান হতে
বন-অন্ধকারঘন কোন্ গ্রামপথে
যেতে যেতে গৃহমুখে বালক-পথিক ।
উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর নিশ্চিন্ত নির্ভীক
কাঁপিছে সপ্তম সুরে , তীব্র উচ্চতান
সন্ধ্যারে কাটিয়া যেন করিবে দুখান ।
দেখিতে না পাই তারে । ওই যে সম্মুখে
প্রান্তরের সর্বপ্রান্তে, দক্ষিণের মুখে,
আখের খেতের পারে , কদলী সুপারি
নিবিড় বাঁশের বন, মাঝখানে তারি
বিশ্রাম করিছে গ্রাম, হোথা আঁখি ধায় ।
হোথা কোন্ গৃহ-পানে গেয়ে চলে যায়
কোন্ রাখালের ছেলে, নাহি ভাবে কিছু,
নাহি চায় শূন্য-পানে, নাহি আগুপিছু ।
দেখে শুনে মনে পড়ে সেই সন্ধ্যাবেলা
শৈশবের । কত গল্প, কত বাল্যখেলা ,
এক বিছানায় শুয়ে মোরা সঙ্গী তিন;
সে কি আজিকার কথা, হল কত দিন ।
এখনো কি বৃদ্ধ হয়ে যায় নি সংসার।
ভোলে নাই খেলাধুলা, নয়নে তাহার
আসে নাই নিদ্রাবেশ শান্ত সুশীতল,
বাল্যের খেলানাগুলি করিয়া বদল
পায় নি কঠিন জ্ঞান? দাঁড়ায়ে হেথায়
নির্জন মাঠের মাঝে , নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়,
শুনিয়া কাহার গান পড়ি গেল মনে---
কত শত নদীতীরে, কত আম্রবনে,
কাংস্যঘন্টামুখরিত মন্দিরের ধারে,
কত শস্যক্ষেত্রপ্রান্তে, পুকুরের পাড়ে
গৃহে গৃহে জাগিতেছে নব হাসিমুখ,
নবীন হৃদয়ভরা নব নব সুখ ,
কত অসম্ভব কথা, অপূর্ব কল্পনা,
কত অমূলক আশা , অশেষ কামনা,
অনন্ত বিশ্বাস । দাঁড়াইয়া অন্ধকারে
দেখিনু নক্ষত্রালোকে, অসীম সংসারে
রয়েছে পৃথিবী ভরি বালিকা বালক,
সন্ধ্যাশয্যা , মার মুখ , দীপের আলোক ।
(--------" সোনার তরী" )
শিলাইদহ
ফাল্গুন ১২৯৮
No comments
THANKS.