ঝুলন -----------রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঝুলন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

আমি         পরানের   সাথে  খেলিব   আজিকে
মরণখেলা
নিশীথবেলা ।
সঘন  বরষা, গগন  আঁধার, 
হেরো  বারিধারে   কাঁদে   চারি  ধার,
ভীষণ   রঙ্গে   ভবতরঙ্গে
ভাষাই   ভেলা ;
বাহির   হয়েছি   স্বপনশয়ন
করিয়া হেলা
রাত্রিবেলা ।


ওগো ,           পবনে গগনে সাগরে আজিকে
কী কল্লোল,
দে দোল্ দোল্ ।
পশ্চাৎ  হতে হা হা ক'রে হাসি
মত্ত ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি,
যেন এ লক্ষ যক্ষশিশুর
অট্টরোল ।
আকাশে পাতালে পাগলে মাতালে
হট্টগোল ।
দে দোল্ দোল্ ।


আজি            জাগিয়া  উঠিয়া  পরান আমার
বসিয়া আছে
বুকের কাছে ।
থাকিয়া থাকিয়া উঠিছে কাঁপিয়া,
ধরিছে আমার বক্ষ চাপিয়া,
নিঠুর  নিবিড় বন্ধনসুখে
হৃদয় নাচে,
ত্রাসে উল্লাসে পরান আমার
ব্যাকুলিয়াছে
বুকের কাছে ।


হায়,          এতকাল আমি রেখেছিনু তারে
যতনভরে
শয়ন -'পরে ।
ব্যথা পাছে লাগে, দুখ পাছে জাগে,
নিশিদিন তাই বহু অনুরাগে
বাসরশয়ন করেছি রচন
কুসুম-থরে,
দুয়ার রুধিয়া রেখেছিনু তারে
গোপন ঘরে
যতনভরে ।


কত              সোহাগ করেছি   চুম্বন   করি
নয়নপাতে
স্নেহের  সাথে ।
শুনায়েছি   তারে   মাথা   রাখি   পাশে 
কত   প্রিয়   নাম   মৃদু   মধুভাষে,
গুঞ্জরতান   করিয়াছি   গান
জ্যোৎস্নারাতে ।
যা-কিছু   মধুর   দিয়েছিনু   তার
দুখানি হাতে
স্নেহের  সাথে ।


শেষে           সুখের   শয়নে   শ্রান্ত পরান
আলস-রসে
আবেশবশে।
পরশ   করিলে   জাগে   না   সে   আর,
কুসুমের   হার   লাগে   গুরুভার,
ঘুমে   জাগরণে   মিশি  একাকার
নিশিদিবসে।
বেদনাবিহীন   অসাড়   বিরাগ
মরমে   পশে
আবেশবশে ।


ঢালি         মধুরে   মধুর   বধূরে   আমার
হারাই   বুঝি ,
পাই   নে   খুঁজি ।
বাসরের   দীপ   নিবে   নিবে  আসে---
ব্যাকুল   নয়নে   হেরি   চারি   পাশে
শুধু   রাশি   রাশি   শুষ্ক   কুসুম
হয়েছে   পুঁজি ।
অতল    স্বপনসাগরে   ডুবিয়া
মরি   যে   যুঝি
কাহারে   খুঁজি ।


তাই          ভেবেছি   আজিকে   খেলিতে   হইবে
নূতন   খেলা
রাত্রিবেলা ।
মরণদোলায়   ধরি    রাশিগাছি
বসিব   দুজনে   বড়ো   কাছাকাছি,
ঝঞ্ঝা   আসিয়া   অট্ট   হাসিয়া
মারিবে   ঠেলা,
আমাতে   প্রাণেতে   খেলিব দুজনে
ঝুলনখেলা
নিশীথবেলা ।


দে   দোল্   দোল্ ।
দে   দোল্   দোল্ ।
এ  মহাসাগরে   তুফান   তোল্ ।
বধূরে   আমার পেয়েছি   আবার---
ভরেছে কোল ।
প্রিয়ারে   আমার   তুলেছে   জাগায়ে
প্রলয়রোল ।
বক্ষ-শোণিতে   উঠেছে   আবার
কী   হিল্লোল!
ভিতরে   বাহিরে   জেগেছে   আমার
কী   কল্লোল!


উড়ে   কুন্তল ,   উড়ে   অঞ্চল,
উড়ে   বনমালা   বায়ুচঞ্চল,
বাজে   কঙ্কণ   বাজে   কিঙ্কিণী
মত্ত-বোল ।
দে   দোল্   দোল্ ।
আয়   রে   ঝঞ্ঝা,   পরান-বধূর
আবরণরাশি  করিয়া   দে   দূর,
করি   লুণ্ঠন   অবগুণ্ঠন-
বসন   খোল্ ।
দে   দোল্    দোল্ ।


প্রাণেতে   আমাতে   মুখোমুখি   আজ
চিনি   লব   দোঁহে   ছাড়ি   ভয়-লাজ,
বক্ষে   বক্ষে   পরশিব   দোঁহে
ভাবে   বিভোল ।
দে   দোল্   দোল্ ।
স্বপ্ন   টুটিয়া   বাহিরেছে   আজ
দুটো   পাগল ।
দে   দোল্   দোল্ ।

                                     (------- " সোনার তরী " )
রামপুর  বোয়ালিয়া                                 
১৫   চৈত্র   ১২৯৯                                 



No comments

THANKS.

মাসি পিসি -----------------------------------জয় গোস্বামী

 মাসি পিসি  জয়   গোস্বামী  ফুল  ছুঁয়ে  যায় চোখের  পাতায়,  জল ছুঁয়ে যায় ঠোঁটে ঘুমপাড়ানি  মাসিপিসি  রাত  থাকতে ওঠে  শুকতারাটি...

Theme images by luoman. Powered by Blogger.