লজ্জা -----------রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
লজ্জা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার হৃদয় প্রাণ
সকলি করেছি দান,
কেবল শরমখানি রেখেছি ।
চাহিয়া নিজের পানে
নিশিদিন সাবধানে
সযতনে আপনারে ঢেকেছি ।
হে বঁধু , এ স্বচ্ছ বাস
করে মোরে পরিহাস,
সতত রাখিতে নারি ধরিয়া---
চাহিয়া আঁখির কোণে
তুমি হাস মনে মনে,
আমি তাই লাজে যাই মরিয়া ।
দক্ষিণ পবনভরে
অঞ্চল উড়িয়া পড়ে
কখন যে , নাহি পারি লখিতে,
পুলকব্যাকুল হিয়া
অঙ্গে উঠে বিকশিয়া,
আবার চেতনা হয় চকিতে ।
বদ্ধ গৃহে করি বাস
রুদ্ধ যবে হয় শ্বাস
আধেক বসনবন্ধ খুলিয়া
বসি গিয়া বাতায়নে ,
সুখসন্ধ্যাসমীরণে
ক্ষণতরে আপনারে ভুলিয়া ।
পূর্ণচন্দ্রকররাশি
মূর্ছাতুর পড়ে আসি
এই নবযৌবনের মুকুলে,
অঙ্গ মোর ভালোবেসে
ঢেকে দেয় মৃদু হেসে
আপনার লাবণ্যের দুকূলে---
মুখে বক্ষে কেশপাশে
ফিরে বায়ু খেলা-আশে,
কুসুমের গন্ধ ভাসে গগনে---
হেনকালে তুমি এলে
মনে হয় স্বপ্ন ব'লে,
কিছু আর নাহি থাকে স্মরণে ।
থাক্ বঁধু, দাও ছেড়ে,
ওটুকু নিয়ো না কেড়ে,
এ শরম দাও মোরে রাখিতে---
সকলের অবশেষ
এইটুকু লাজলেশ
আপনারে আধখানি ঢাকিতে ।
ছলছল-দুনয়ান
করিয়ো না অভিমান,
আমিও যে কত নিশি কেঁদেছি,
বুঝাতে পারি নে যেন
সব দিয়ে তবু কেন
সবটুকু লাজ দিয়ে বেঁধেছি---
কেন যে তোমার কাছে
একটু গোপন আছে,
একটু রয়েছি মুখ হেলায়ে।
এ নহে গো অবিশ্বাস---
নহে সখা , পরিহাস,
নহে নহে ছলনার খেলা এ।
বসন্তনিশীথে বঁধু,
লহো গন্ধ, লহো মধু,
সোহাগে মুখের পানে তাকিয়ো ।
দিয়ো দোল আশেপাশে,
কোয়ো কথা মৃদু ভাষে---
শুধু এর বৃন্তটুকু রাখিয়ো ।
সেটুকুতে ভর করি
এমন মাধুরী ধরি
তোমা-পানে আছি আমি ফুটিয়া,
এমন মোহনভঙ্গে
আমার সকল অঙ্গে
নবীন লাবণ্য যায় লুটিয়া ।
এমন সকল বেলা
পবনে চঞ্চল খেলা,
বসন্তকুসুম-মেলা দুধারি।
শুন বঁধু , শুন তবে
সকলি তোমার হবে
কেবল শরম থাক্ আমারি ।
(-------- "সোনার তরী ")
২৮ আষাঢ় ১৩০০
No comments
THANKS.