জুতা-আবিষ্কার --------রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জুতা-আবিষ্কার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কহিলা হবু, 'শুন গো গোবু রায়,
কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র---
মলিন ধুলা লাগিবে কেন পায়
ধরণী-মাঝে চরণ ফেলা মাত্র ।
তোমরা শুধু বেতন লহ বাঁটি
রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি ।
আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি,
রাজ্যে মোর একি এ অনাসৃষ্টি ।
শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার
নহিলে কারো রক্ষা নাহি
শুনিয়া গোবু ভাবিয়া হল খুন,
দারুণ ত্রাসে ঘর্ম বহে গাত্রে ।
পন্ডিতের হইল মুখ চুন
পাত্রদের নিদ্রা নাহি রাত্রে।
রান্নাঘরে নাহিকো চড়ে হাঁড়ি,
কান্নাকাটি পড়িল বাড়ি-মধ্যে,
অশ্রুজলে ভাসায়ে পাকা দাড়ি
কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে,
' যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে
পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে ।'
শুনিয়া রাজা ভাবিল দুলি দুলি,
কহিল শেষ , ' কথাটা বটে সত্য ,
কিন্তু আগে বিদায় করো ধুলি,
ভাবিয়ো পরে পদধূলির তত্ত্ব ।
ধুলা-অভাবে না পেলে পদধুলা
তোমরা সবে মাহিনা খাও মিথ্যে,
কেন বা তবে পুষিনু এতগুলা
উপাধি-ধরা বৈজ্ঞানিক ভৃত্যে ।
আগের কাজ আগে তো তুমি সারো
পরের কথা ভাবিয়ো পরে আরো ।'
আঁধার দেখে রাজার কথা শুনি,
যতনভরে আনিল তবে মন্ত্রী
যেখানে যত আছিল জ্ঞানীগুণী
দেশে বিদেশে যতেক ছিল যন্ত্রী ।
বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি,
ফুরায়ে গেল উনিশ পিপে নস্য ।
অনেক ভেবে কহিল , ' গেলে মাটি
ধরায় তবে কোথায় হবে শস্য ।'
কহিল রাজা, ' তাই যদি না হবে,
পন্ডিতেরা রয়েছ কেন তবে? '
সকলে মিলি যুক্তি করি শেষে
কিনিল ঝাঁটা সাড়ে সতেরো লক্ষ,
ঝাঁটের চোটে পথের ধুলা এসে
ভরিয়া দিল রাজার মুখ বক্ষ ।
ধুলায় কেহ মেলিতে নারে চোখ,
ধুলার মেঘে পড়িল ঢাকা সূর্য ।
ধুলার বেগে কাশিয়া মরে লোক ,
ধুলার মাঝে নগর হল ঊহ্য ।
কহিল রাজা , ' করিতে ধুলা দূর,
জগৎ হল ধুলায় ভরপুর ।'
তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক
মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি ।
পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক,
নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি ।
জলের জীব মরিল জল বিনা,
ডাঙার প্রাণী সাঁতার করে চেষ্টা ।
পাঁকের তলে মজিল বেচা-কিনা,
সর্দিজ্বরে উজার হল দেশটা ।
কহিল রাজা , ' এমনি সব গাধা
ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা ।'
আবার সবে ডাকিল পরামর্শে;
বসিল পুন যতেক গুণবন্ত;
ঘুরিয়া মাথা হেরিল চোখে সর্ষে,
ধুলার হায় নাহিকো পায় অন্ত ।
কহিল , ' মহী মাদুর দিয়ে ঢাকো,
ফরাশ পাতি করিব ধুলা বন্ধ ।'
কহিল কেহ , ' রাজারে ঘরে রাখো
কোথাও যেন না থাকো কোনো রন্ধ্র ।
ধুলার মাঝে না যদি দেন পা
তা হলে পায়ে ধুলা তো লাগে না ।'
কহিল রাজা, ' সে কথা বড়ো খাঁটি,
কিন্তু মোর হতেছে মনে সন্ধ
মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি
দিবস রাতি রহিলে আমি বন্ধ ।'
কহিল সবে , ' চামারে তবে ডাকি
চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী ।
ধূলির মহী ঝুলির মাঝে ঢাকি
মহীপতির রহিবে মহাকীর্তি ।'
কহিল সবে, ' হবে সে অবহেলে,
যোগ্যমতো চামর যদি মেলে ।'
রাজার চর ধাইল হেথা হোথা,
ছুটিল সবে ছাড়িয়া সব কর্ম ।
যোগ্যমতো চামার নাহি কোথা,
না মিলে তত উচিত-মতো চর্ম ।
তখন ধীরে চামার-কুলপতি
কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ,
'বলিতে পারি করিলে অনুমতি
সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ ।
নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে
ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।'
কহিল রাজা, ' এত কি হবে সিধে,
ভাবিয়া ম'ল সকল দেশসুদ্ধ।'
মন্ত্রী কহে , ' বেটারে শূল বিঁধে
কারার মাঝে করিয়া রাখো রুদ্ধ।'
রাজার পদ চর্ম-আবরণে
ঢাকিল বুড়া বসিয়া পদোপান্তে।
মন্ত্রী কহে, ' আমারো ছিল মনে,
কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে।'
সেদিন হতে চলিল জুতো পরা ,
বাঁচিল গোবু, রক্ষা পেল ধরা ।
(----------"কল্পনা" )
১৩০৪
No comments
THANKS.