বৈষ্ণব কবিতা ---------রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বৈষ্ণব কবিতা 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

শুধু   বৈকুণ্ঠের  তরে  বৈষ্ণবের  গান !
পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান-অভিমান, 
অভিসার , প্রেমলীলা, বিরহ-মিলন, 
বৃন্দাবনগাথা --- এই   প্রণয়-স্বপন
শ্রাবণের  শর্বরীতে কালিন্দীর কূলে, 
চারি চক্ষে চেয়ে দেখা কদম্বের  মূলে 
শরমে  সম্ভ্রমে--- এ  কি  শুধু দেবতার !
এ   সংগীতরসধারা নহে মিটাবার
দীন  মর্ত্যবাসী  এই নরনারীদের 
প্রতিরজনীর  আর  প্রতিদিবসের
তপ্ত  প্রেমতৃষা ?                         

                               এ  গীত -উৎসব-মাঝে 
শুধু   তিনি  আর  ভক্ত  নির্জনে  বিরাজে  ;
দাঁড়ায়ে  বাহির-দ্বারে  মোরা  নরনারী 
উৎসুক  শ্রবণ  পাতি  শুনি  যদি  তারি  
দুয়েকটি  তান---দূর  হতে  তাই  শুনে
তরুণ  বসন্তে  যদি  নবীন  ফাল্গুনে
অন্তর  পুলকি  উঠে, শুনি  সেই  সুর
সহসা  দেখিতে   পাই   দ্বিগুণ  মধুর  
আমাদের  ধরা --- মধুময়  হয়ে উঠে 
আমাদের  বনচ্ছায়ে  যে  নদীটি  ছুটে, 
মোদের  কুটীর-প্রান্তে  যে  কদম্ব   ফুটে 
বরষার  দিনে --- সেই   প্রেমাতুর  তানে  
যদি ফিরে চেয়ে দেখি  মোর  পার্শ্ব-পানে
ধরি  মোর   বাম  বাহু  রয়েছে   দাঁড়ায়ে 
ধরার সঙ্গিনী  মোর,  হৃদয়  বাড়ায়ে 
 মোর  দিকে  ,  বহি  নিজ  মৌন  ভালোবাসা, 
ওই  গানে  যদি  বা  সে  পায়  নিজ   ভাষা ,
যদি  তার   মুখে   ফুটে  পূর্ণ  প্রেমজ্যোতি---
তোমার   কি   তাঁর, বন্ধু,  তাহে  কার  ক্ষতি? 


সত্য   করে  কহো  মোরে  হে    বৈষ্ণব   কবি,
কোথা  তুমি পেয়েছিলে এই   প্রেমচ্ছবি , 
কোথা  তুমি  শিখেছিলে  এই  প্রেমগান
বিরহ-তাপিত । হেরি   কাহার   নয়ান,
রাধিকার   অশ্রু-আঁখি  পড়েছিল  মনে।
বিজন   বসন্তরাতে  মিলনশয়নে 
কে   তোমারে  বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে,
আপনার  হৃদয়ের  অগাধ  সাগরে 
রেখেছিল  মগ্ন  করি ! এত  প্রেমকথা---
রাধিকার   চিত্তদীর্ণ  তীব্র  ব্যাকুলতা 
চুরি  করি  লইয়াছ   কার  মুখ, কার
আঁখি  হতে !  আজ  তার  নাহি  অধিকার 
সে   সংগীতে !  তারি  নারী হৃদয়-সঞ্চিত
তার  ভাষা  হতে  তারে  করিবে  বঞ্চিত 
চিরদিন!                 

                              আমাদেরি   কুটীর-কাননে
ফুটে  পুষ্প,  কেহ   দেয়  দেবতা-চরণে ,
কেহ  রাখে  প্রিয়জন-তরে --- তাহে  তাঁর 
নাহি  অসন্তোষ । এই   প্রেমগীতিহার
গাঁথা  হয়  নরনারী-মিলনমেলায়,
কেহ  দেয়  তাঁরে, কেহ  বঁধুর  গলায় ।
দেবতারে   যাহা  দিতে  পারি,  দিই  তাই 
প্রিয়জনে  --- প্রিয়জনে যাহা  দিতে  পাই,
তাই    দিই  দেবতারে;  আর  পাব  কোথা! 
দেবতারে   প্রিয়  করি,  প্রিয়েরে  দেবতা ।

বৈষ্ণব   কবির গাঁথা  প্রেম-উপহার
চলিয়াছে    নিশিদিন   কত  ভারে  ভার
বৈকুণ্ঠের পথে ।  মধ্যপথে   নরনারী 
অক্ষয়  সে  সুধারাশি   করি  কাড়াকাড়ি
লইতেছে   আপনার  প্রিয়গৃহতরে
যথাসাধ্য  যে  যাহার; যুগে  যুগান্তরে
চিরদিন  পৃথিবীতে  যুবকযুবতী 
নরনারী   এমনি  চঞ্চল  মতিগতি ।
দুই   পক্ষে   মিলে  একেবারে  আত্মহারা 
অবোধ  অজ্ঞান ।  সৌন্দর্যের  দস্যু   তারা 
লুটেপুটে নিতে  চায়  সব । এত   গীতি, 
এত   ছন্দ, এত   ভাবে  উচ্ছ্বসিত  প্রীতি, 
এত  মধুরতা   দ্বারের   সম্মুখ   দিয়া 
বহে  যায়--- তাই  তারা  পড়েছে   আসিয়া
সবে   মিলি   কলরবে   সেই  সুধাস্রোতে ।
সমুদ্রবাহিনী   সেই   প্রেমধারা   হতে 
কলস  ভরিয়া  তারা লয়ে   যায়  তীরে 
বিচার   না  করি  কিছু ,আপন   কুটীরে
আপনার   তরে । তুমি  মিছে  ধর  দোষ,
হে   সাধু  পন্ডিত ,  মিছে  করিতেছ   রোষ ।
যাঁর ধন  তিনি  ওই  অপার সন্তোষে
অসীম   স্নেহের   হাসি  হাসিছেন বসে ।

শাহাজাদপুর                         ( ---- "সোনার তরী " )
১৮  আষাঢ় ১২৯৯                                        

No comments

THANKS.

মাসি পিসি -----------------------------------জয় গোস্বামী

 মাসি পিসি  জয়   গোস্বামী  ফুল  ছুঁয়ে  যায় চোখের  পাতায়,  জল ছুঁয়ে যায় ঠোঁটে ঘুমপাড়ানি  মাসিপিসি  রাত  থাকতে ওঠে  শুকতারাটি...

Theme images by luoman. Powered by Blogger.